জীবনের সবকিছুর একটা পরিকল্পনা আছে। তেমনি বিদেশে উচ্চশিক্ষা করতে চাইলেও প্রয়োজন সুপরিকল্পিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ। এর জন্য আগে থেকে পরিকল্পনা থাক...
জীবনের সবকিছুর একটা পরিকল্পনা আছে। তেমনি বিদেশে উচ্চশিক্ষা করতে চাইলেও প্রয়োজন সুপরিকল্পিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ। এর জন্য আগে থেকে পরিকল্পনা থাকা জরুরি। বিশেষ করে যারা বিদেশে স্নাতক করতে চান তাদের অন্তত বছর দেড়েক ধরে এর জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। দেশে এইচএসসি পরীক্ষা শেষ করে অনেকে দেশে ভর্তি হন। অনেকে চিন্তা করেন বিদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক করবেন। মূলত তাদের জন্যই আজকের লেখাটি।
বিদেশে পড়ার পরিকল্পনা গ্রহণ:
শুরুতেই বলেছি পরিকল্পনার কথা। এইচএসসির শুরু থেকে কিংবা তারও আগে থেকে পরিকল্পনা থাকতে হবে যে, দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ব নাকি বিদেশে স্নাতক করবো। যদি বিদেশে করতে চান। তাহলে সেভাবে সিদ্ধান্ত স্থির করতে হবে। মূলত কেউ যদি বড় কিছুর স্বপ্ন দেখেন এবং সে অনুযায়ী পরিকল্পনা নেন তিনি তাতে সফল হবেনই। তাহলে সবার আগে স্বপ্ন দেখা এবং তারপর পরিকল্পনা গ্রহণ করে সিদ্ধান্ত স্থির করা। এরপর আসছে বাকি বিষয়গুলো। চলুন সেগুলো জেনে নেওয়া যাক।
দেশ:
প্রথমেই একজন শিক্ষার্থীকে ঠিক করতে হবে তিনি কোন দেশে পড়তে যেতে চান। কেননা, একেকটি দেশের শিক্ষা পদ্ধতি ও ব্যবস্থাপনা, খরচ, ভর্তি চাহিদায় ভিন্নতা আছে। তাই পার্থক্য বিবেচনা করেই নিজের চিন্তা অনুযায়ী এগিয়ে যেতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় বাছাইকরণ:
একটি দেশে বিভিন্ন মানের বিশ্ববিদ্যালয় থাকে। যদি বিদেশে প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়কে গুরুত্ব দেওয়া হয়। এরপরও সুনাম, শহর ভেদে অবস্থানে ভিন্নতা থাকে। তাই আপনি কোন দেশে যেতে চান তার বাছাই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পর বাছাই করতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়।
সাবজেক্ট বাছাইকরণ:
পছন্দ অনুযায়ী একটি বিশ্ববিদ্যালয় ঠিক করলেন। এবার আপনার পছন্দের সাবজেক্ট বাছাই করে নিন। শুরু থেকে নিশ্চয় আপনার নির্দিষ্ট সাবজেক্টে পড়ার টার্গেট আছে। তাহলে সে সাবজেক্ট সম্পর্কে খোঁজ খবর নিন। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে ঢুঁ মারবেন। শুরু থেকে শেষ পযন্ত দেখে-ভেবে সাবজেক্ট ঠিক করতে হবে।
সামর্থ যাচাই:
দেশ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাবজেক্ট বাছাইয়ের পরই আসে নিজের সামর্থের দিকটা। আপনি ওপরের যেসব বিষয় পছন্দ করেছেন সে অনুযায়ী এগিয়ে যাওয়ার জন্য আপনার আর্থিক সামর্থ কতোটা তা যাচাই করতে হবে। ভাবতে হবে যে, সাবজেক্ট ও আর্থিক সামর্থের সঙ্গে মিলিয়ে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া যেতে পারে এটা নির্ভর করে। এক্ষেত্রেও একেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম বা চাহিদা, টিউশন ফির সঙ্গে আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্থক্য থাকে।
ভর্তির সময় অনুযায়ী প্রস্তুতি:
যুক্তরাজ্যসহ অনেক দেশে সেপ্টেম্বরে ভর্তি সেশন শুরু হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে অন্তত এক বছর আগে থেকে প্রস্তুতি নেয়া শুরু করতে হবে। বিশেষ করে ইংরেজির ভর্তি চাহিদা যেমন, আইইএলটিএস বা অন্যান্য চাহিদা প্রস্তুতি করা, বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগাযোগ, আবেদন ইত্যাদি অন্তত একবছর আগে থেকে শুরু করতে হবে। প্রায় সকল বিশেষজ্ঞই এমনটা পরামর্শ দিয়ে থাকেন। মূলত যে বিষয়ে পড়তে চান, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে হবে। সেই সঙ্গে দেখতে হবে আপনার আর্থিক সামর্থ্য এবং পছন্দের সঙ্গে মিলছে কিনা।
ভাষা দক্ষতার প্রমাণ:
সংশ্লিষ্ট দেশে যাওয়ার চিন্তা করলে প্রস্তুতি হিসেবে প্রথমেই আসে ভাষার প্রশ্ন। সাধারণত এক্ষেত্রে আইইএলটিএস, টোফেল, স্যাট অথবা জিআরই পরীক্ষা দিতে হয়। একেকটি দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ভেদে এসব চাহিদার পার্থক্য থাকতে পারে। অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় দেশগুলোর বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে আইইএলটিএসে ব্যান্ড স্কোর অন্তত ৬ থাকা দরকার। তবে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় এর চেয়ে বেশিও চাইতে পারে। তবে আমেরিকাসহ আরো দেশের কোন কোন সাবজেক্টে টোফেল, স্যাট বা জিআরই দরকার হতে পারে। ইদানিং আমেরিকাতেও আইইএলটিএস হলেও চলছে। আবার জার্মানি, ফ্রান্স, সুইডেন, নরওয়ের মতো ইউরোপীয় দেশে পড়তে গেলে যেমন ইংরেজিতে পড়াশোনা করার সুযোগ রয়েছে, আবার অনেক ক্ষেত্রে সেই দেশের ভাষার দক্ষতা দরকার হতে পারে। বিশেষ করে জার্মানির মতো দেশে বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ নিতে হলে জার্মান ভাষা জানতে হবে। এরকম করে চীনে বা জাপানে যেতে চাইলেও তাদের ভাষা জানতে হবে। তখন স্কলারশিপ ম্যানেজ করা সম্ভব হবে সহজে।
একাডেমিক রেজাল্ট:
এবার আসে আপনার ইতি:পূর্বের পড়ালেখার ফলাফল। বাংলাদেশে পড়াশোনার ফলাফলের ওপর ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ের বা বিষয়ে ভর্তির ব্যাপারটিও অনেক সময় নির্ভর করে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে ইমেইল করেও পরামর্শ চাওয়া যেতে পারে। অনেক সময় ইংরেজি দক্ষতার ব্যান্ডস্কোরও ভর্তি বা বিষয় পাওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে।
ভর্তির প্রক্রিয়া:
বিশ্ববিদ্যালয় ও বিষয় বাছাই করার পরে অনলাইনের মাধ্যমে সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করতে হবে। নরওয়ে, নেদারল্যান্ডস, সুইডেন, ডেনমার্ক ইত্যাদি দেশের কেন্দ্রীয় ভর্তি ব্যবস্থাপনার ওয়েবসাইট আছে। সেখানে আবেদন করলে আপনার যোগ্যতা অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় বেছে দেয়া হয়।তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে আবেদন করতে হয়।সেখানে পড়াশোনার সকল সনদ কাগজপত্র স্ক্যান করে তুলে দিতে হতে পারে। পাশাপাশি এসব সেগুলোর ফটোকপি কুরিয়ার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠিকানায় পাঠাতে হতে পারে। সাধারণত কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই আবেদন গ্রহণ বা বাতিলের সিদ্ধান্ত ইমেইলের মাধ্যমে জানানো হয়।
ভিসা আবেদনের প্রস্তুতি:
আপনি যদি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়ে যান, তাহলে প্রস্তুতি নিতে হবে ভিসা আবেদনের। প্রশ্ন হলো, ভিসা আবেদনের প্রস্তুতিতে কী কী দরকার?
পাসপোর্ট:
বিদেশে যেতে চাইলে সবার আগে দরকার একটি পাসপোর্ট। আপনার অবস্থান অনুযায়ী যেকোনো পাসপোর্ট অফিস থেকে পাসপোর্ট আবেদন করে নিতে হবে। সাধারণ ১০ দিন থেকে ১ মাসের মধ্যে পাসপোর্ট পাওয়া যায়। এর জন্য কিছু প্রক্রিয়া আছে। সেসব প্রক্রিয়া অনুসরণ করে পাসপোর্ট নিয়ে নিন এবং সেটা হাতে রাখুন।
আর্থিক সচ্ছলতার প্রমাণপত্র:
ভিসা আবেদনের সময় আর্থিক সচ্ছলতার প্রমাণ দেখাতে হবে। প্রায় সব দেশেই শিক্ষার্থী ভিসার ক্ষেত্রে দূতাবাস কর্মকর্তারা দেখতে চাইবেন যে, শিক্ষার্থীর পড়াশোনা ও থাকাখাওয়ার খরচ সে বহন করতে সক্ষম।দেশ ভেদে টিউশন ফি হিসাবে অন্তত বছরে অন্তত ৮-১০ লাখ টাকা থেকে শুরু করে ১৮-২০ লাখ টাকা খরচের সামর্থ থাকতে হবে। এর সঙ্গে শিক্ষার্থীর থাকা-খাওয়া, যাতায়াত, পোশাক, হাতখরচ, চিকিৎসা যোগ করতে হবে। লন্ডনের ক্ষেত্রে যেমন এক্ষেত্রে বছরে আরো অন্তত ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখতে হবে। এই খরচের টাকা ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে।অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সেমিস্টারের ফি অগ্রিম পরিশোধ করতে হয়।
স্বাস্থ্য বীমা:
অনেক দেশে স্বাস্থ্য বীমা থাকা বাধ্যতামূলক। সেটি অবশ্য বাংলাদেশের বিভিন্ন বীমা এজেন্সি করে থাকে, যেসব এজেন্সির নাম দূতাবাসের ওয়েবসাইটে পাওয়া যাবে।
আবাসন:
সব বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব আবাসন ব্যবস্থা রয়েছে। শিক্ষার্থীদের পূর্বেই জানাতে হবে যে, তারা সেই আবাসন সুবিধা নিতে চান কিনা। অথবা শিক্ষার্থীরা চাইলে নিজেরা আলাদাভাবে বাসা ভাড়া করেও থাকতে পারেন। এসব ক্ষেত্রে সাধারণত নিজেদের রান্না করে খাওয়ার ব্যবস্থা থাকে।
স্কলারশিপের আবেদন:
আবেদনের সময় উল্লেখ করতে হবে যে, বৃত্তি নিতে চান কিনা। একই সময় বৃত্তির জন্যই প্রস্তুতি নিতে হবে।ভারত, তুরস্ক, জার্মানি, জাপান, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেই বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য সরকারিভাবেই নানা ধরণের বৃত্তি রয়েছে।এরকম বিখ্যাত কয়েকটি বৃত্তি হলো জাপানের মনবুশো বৃত্তি ও মনবুকাগাকুশো বৃত্তি, , এমএইচটিটি স্কলারশিপ প্রোগ্রাম, জার্মানির ডিএএডি, অস্ট্রেলিয়ার ডেভেলপমেন্ট স্কলারশিপ, যুক্তরাজ্যের কমনওয়েলথ স্কলারশিপ, শেভেনিং স্কলারশিপ, যুক্তরাষ্ট্রের ফুলব্রাইট ফরেন স্টুডেন্টস প্রোগ্রাম, কানাডার হাম্বার ইন্টারন্যাশনাল এন্ট্রান্স স্কলারশিপ, তুরস্কের বুরসলারি বৃত্তি ইত্যাদি। এছাড়া প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষার্থীদের পূর্ণ বা আংশিক বৃত্তির সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের ওয়েবসাইটের বিভিন্ন দেশের দূতাবাস বা সরকারি বৃত্তির নোটিশ পাওয়া যাবে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অনলাইনেই প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিয়ে বৃত্তির আবেদন করা যেতে পারে।
ভিসার আবেদন:
ভিসা আবেদনের সময় আবেদন পত্রের কাগজপত্রের মধ্যে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির অফার লেটার থাকতে হবে। এর সঙ্গে শিক্ষার্থীর আর্থিক সক্ষমতার প্রমাণ, অর্থাৎ ব্যাংক হিসাবে নিজের নামে বা গ্যারান্টারের নামে পর্যাপ্ত অর্থের ব্যবস্থা থাকতে হবে। অথবা বৃত্তি পাওয়ার প্রমাণপত্র জমা দিন।
সবকিছু সম্পন্ন করে আপনি পেয়ে গেলেন কাঙ্ক্ষিত একটি ভিসা। এবার শুধু বিমানের টিকেট কেটে উড়াল দেওয়ার পালা। পড়তে চলে যান স্বপ্নে দেশে। তবে হ্যাঁ, করোনা মহামারীর কারণে এখন কিছু নতুন শর্ত যুক্ত হয়েছে। তা হলো, করোনা নেগেটেভি এবং ভ্যাকসিন দেয়ার সনদ। এভাবে সবকিছু সম্পন্ন হলে আর কোনো বাধা থাকবে না আপনার সামনে।